গল্পটা একজন ছাপোষা টাইপিস্টের, গল্পটা তার ব্যর্থপ্রায় ভালবাসার। অনেকদিন আগে তার কাছে চাকরির ফরমায়েশি চিঠি লিখতে যে তরুণীটা এসেছিল, গল্পটা তার-ও। গল্পটা একটা আকাশের রঙ কালো করা বিকেলের, যে বিকেলে টাইপিস্ট তরুণ দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার ধারে, সেই তরুণীর অপেক্ষায়। হাতে তার ছেঁড়া ছাতা, আর তারচেয়েও ছেঁড়া একটা জীবন, যেখানে স্বপ্নের রঙগুলো ফিকে হয়ে গেছে সেই ছেঁড়া ছাতার ন্যায় আর ভবিষ্যৎ সেই বিকালের মতোই অন্ধকার। তবুও সে প্রেমিকার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে, অপেক্ষা করে আরো একটি সন্ধ্যার যেখানে পাশাপাশি দুজনে হেটে যাবে বরাবরের মতোই সেই পুরনো গল্প করতে করতে। গোলাপ কেনার সামর্থ্য তার নেই, তাই তার প্রেমিকার কাছে গানে গানে সে একটাই আবদার করে যায়, 'ববি রায়ের কাছে চলে যেও না '। কি নিদারুণ অসহায় এই আবদার!
কিন্তু তার এই আবদার অন্ধ আবদার না। সে জানে তার সংসারে যেমন নিদারুণ অভাব, মেয়েটার সংসারেও তাই। চাকরিটা রাখতে চাইলে, পদোন্নতি করতে চাইলে ববি রায় নামের লোকটাকে খুশি রাখতে হবে, মনোহারি রুপে নিজেকে সাজিয়ে, ঠোট রাঙিয়ে অফিস করতে হবে, অফিসপাড়া খালি হয়ে গেলেও ববি রয়ের রুমে তার সাথে আড্ডা চালিয়ে যেতে হবে,কারণে অকারণে কিশোরীদের মতো খিলখিল হাসতে হবে। তবুও... অসহায় টাইপিস্ট প্রেমিকার কাছে আবদার করে গান গায়... "জানি টাকা-কড়ি আর মারুতি গাড়ির প্রয়োজন আছে... তবু হাল ছেড়ে দিও না
ববি রায়ের সাথে চলে যেও না- এ অসময়।"
প্রেমিকাকে সে মনে করিয়ে দেয়, সেই অতীতের গান যেখানে প্রেমিকার মুখে শুধু বোকা টাইপিস্টকেই ভালবাসার গান ছিল। যখন আঙুল কেবল যন্ত্রের মতো টাইপ করতো, তখনো তার মনের ভেতর শুধু বোকা টাইপিস্টেরই নাম লেখা ছিল। কিন্তু সে দিন আর নেই। কঠোর বাস্তবতা অথবা পদোন্নতির লোভ মেয়েটিকে ভুলিয়ে দিয়েছে সেদিন গুলোর কথা, ভুলে গেছে সেই ছাপোষা টাইপিস্টের সত্যিকারের ভালবাসার মূল্য, ভুলে গেছে হৃদয়ে টাইপ করা নামটা, ভুলে গেছে সেই ভাঙা দেয়াল-কানাগলির অতীত।
তবুও বোকা টাইপিস্ট ছেঁড়া ছাতা নিয়ে আজও বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে তার জন্য অপেক্ষা করবে। কিন্তু মেয়েটা হয়তো ববি রায়ের আবদারে তার গাড়িতে করেই, টাইপিস্টের ভালবাসাকে অপমান করতে করতে, ববি রায়ের পাশে বসে বাড়ি ফিরে যাবে।
আর এদিকে আপত দৃষ্টিতে বোকা টাইপিস্ট প্রেমিক ভয়াবহ অসাহায়ত্ব নিয়ে বারবার গেয়ে যেবে,
"আবার বলছি তোমায়
ববি রায়ের সাথে চলে যেও না ছেড়ে যেও না,
শোনো ববি রায়ের কথায় বয়ে যেও না ফেলে আমায়,
জানি টাকা কড়ি আর মারুতি গাড়ির প্রয়োজন আছে
তবু হাল ছেড়ে দিও না,
ববি রায়ের সাথে চলে যেও না- এ দুঃসময়।"
_________________________________
গানের নাম: ববি রয়
আর্টিস্ট : প্রিয় অঞ্জন দত্ত
অ্যালবাম : ভালবাসি তোমায়
সাল : ১৯৯৬
________________________________
আমি অঞ্জনের এই গানটা শুনি প্রথম ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে। বন্ধুবর বয়াতি গানটা দিয়েছিল। সেদিনই প্রেমে পড়েছিলাম সেই গানটার। এরপর থেকে হাজার বার শুনেছি এই গান, বেঁচে থাকলে আরো হাজারবার শুনবো। তবুও এই গান আমার কাছে কখনো পুরনো হবে না। গানের প্রেমিক টাইপিস্টের যেই স্ট্রাগল তার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই, তবুও তার প্রতিটা কথায় আমি তার অসহায়ত্ব, তার জীবনের নির্মম বাস্তবতাকে, তার প্রবল ভালবাসাকে অনুভব করতে পারি। তার প্রেমিকা তার ভালবাসাকে অপমান করলেও সেই বাস্তবতার কারণেই তার উপর রাগ করতে পারি না। যদিও জানি এটা কেবলই একটা গান... তবুও মেয়েটার ওপর প্রচণ্ড অভিমান হয়, ববি রায় নামক লোকটাকে পেটাতে ইচ্ছে করে।
.
দিস ইজ আওয়ার অঞ্জন দত্ত,এটাই অঞ্জন দত্তের কারিশমা।